কওমি সনদের যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়নের দাবীতে আয়োজিত জাতীয় সেমিনারে বক্তারা
“কওমি শিক্ষার্থীদের প্রতি সকল বৈষম্যের অবসান হোক”
সেমিনারে ১৩ দফা প্রস্তাবনা ও ২দফা কর্মসূচি ঘোষণা
দেশের ঐতিহ্যবাহী অন্যতম শিক্ষাধারা কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বরাবরই বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকার পরও রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিতই থেকেছে সবসময়। সর্বশেষ বিগত সরকারের আমলে কওমি মাদরাসার তাকমীল তথা দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্স সমমান দিয়ে গেজেট পাশ করা হলেও এর আইনী ও নৈতিক দিকগুলো একদমই অস্পষ্ট। যার ফলশ্রুতিতে সনদের স্বীকৃতি আসলেও এর যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন এখনও পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে।
আজ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং বৃহস্পতিবার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ সভাপতি মাওলানা নূরুল হুদা ফয়েজীর সভাপতিত্বে আয়োজিত “বৈষম্য নিরসনে কওমি সনদের যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়নের দাবীতে জাতীয় সেমিনরারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেমিনারে উপস্থিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম শায়েখে চরমোনাই বলেন, সনদের স্বীকৃতি এটা কোন অনুকম্পা নয়; এটা কওমী শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার। তাই এর যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রকেই করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, কওমি মাদরাসার বিশেষ স্বকীয়তা আছে, নিজস্বতা আছে। তাই সনদের বাস্তবায়ন হতে হবে কওমির মৌলিকত্ব ও এর ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে আপন জায়গায় ঠিক রেখে। তারা বলেন, সনদের বাস্তবায়ন বলতে আমরা চাচ্ছি এতটুকু সুযোগ, যাতে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের মেধাকে মেলে ধরার সুযোগ পায়। উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলোতে এবং যে কোন প্রতিযোগিতায় বাধাহীনভাবে যেন তারা অংশগ্রহণ করতে পারে। তাদেরকে যেন সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করার সুযোগ কেউ না পায়। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াও কওমি শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে কষ্টসাধ্য করে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে, সুযোগ পেলে যা আরও বহুগুণে ত্বরান্বিত হবে। দেশ ও জাতি তাদের দ্বারা আরও বেশি উপকৃত হবে।
সেমিনারে আারও বক্তব্য রাখেন শাইখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, নারায়ণগঞ্জ ডিআইটি মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুল আউয়াল, জামিয়াতুস-সুন্নাহ‘র পরিচালক মাওলানা নিয়ামতুল্লাহ ফারিদী, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী, জামিয়া নূরিয়া কামরাঙ্গীরচরের মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এর যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লা আমিন, মুফতি মুশতাকুন্নবী কুমিল্লা, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা হাসান জামিল, বিশিষ্ট দায়ী মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আল মোবারক, মুফতি হেমায়েতুল্লাহ কাসেমী, মুফতি আব্দুর রাজ্জাক কাসেমী মুফতি ইমাদ উদ্দিন, মাওলানা তাজ উদ্দিন হামিদী, মুফতি লুৎফর রহমান ফরায়েজী, মুফতি মাহমুদ মাদানী, মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক, মুফতি আব্দুল্লাহ ইয়াহিয়া, মাওলানা এনামুল হক মুসা, মাওলানা আতাউল করিম মাসুদ, মুফতি আবু মোহাম্মদ রাহমানী, মুফতি আম্মার হোসাইন, মাওলানা ইউনুস ঢালী, মুফতি তাজুল ইসলাম মোমেনশাহী, মুফতি সাকিবুল ইসলাম কাসেমী, মাওলানা কাজী ইয়াকুব আত-তাকওয়া ফাউন্ডেশন, মুফতি মোহাম্মদ আলী, মুফতি আমিমুল এহসান, আল-মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ এর মাওলানা হামজা বিন শহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করেন বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ মুফতি আবদুল্লাহ মাসুম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন মুফতি রেজাউল করীম আবরার, মফতি ইসমাইল সিরাজী আল-মাদানী, মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফী, মুফতি আবদুল আজীজ কাসেমী, মাওলানা নূরুল করীম আকরাম।
সেমিনারে ১০ দফা প্রস্তাবনা এবং ০২ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়
স্বীকৃতির মানোন্নয়ন বিষয়ক প্রস্তাবনা:
কার্যকর করার জন্য অনতিবিলম্বে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর অধীনে এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ‘কওমি বিশ্ববিদ্যালয়’ (Qawmi University-QU) প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।
কওমি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন’ এর আওতাভুক্ত হবে। তবে কওমি মাদরাসাসমূহের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে মঞ্জুরী কমিশনের এবং সরকারী সব ধরনের হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার জন্য আল হাইআতুল উলয়ার পক্ষে প্রয়োজনীয় বিধি আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
2. দারুল উলূম দেওবন্দের ০৮টি মূলনীতিই হবে প্রস্তাবিত ‘কওমি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর মূলনীতি।
3. কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফযিলতকে স্নাতক স্তরের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।
4. কওমি মাদরাসার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরকেও যথাক্রমে এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি. সমমান প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে ০৬ টি বোর্ডকে এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ হিসাবে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বোর্ডসমূহ এফিলিয়েটিং অথরিটি হিসাবে কওমি মাদরাসার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যথাক্রমে এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি. সমমান সনদ প্রদান করবে, যা জাতীয়ভাবে স্বীকৃত হবে।
5. প্রস্তাবিত কওমি বিশ্ববিদ্যালয় যেমনিভাবে দাওরায়ে হাদিস ও ফযিলতের পরীক্ষা গ্রহণ, সনদ ইস্যূ, সিলেবাস প্রণয়ন এবং সার্বিক মানোন্নেয়নে কাজ করবে, তদ্রূপ দাওরায়ে হাদিস পরবর্তী উচ্চতর পড়াশোনা/তাখাসসুস বিষয়ক একাডেমিক পাঠও চালু করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হাদিস, ফিকহ, তারিখ, তাফসীর, আরবী ভাষা ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর মানসম্পন্ন তাখাসসুস বিভাগ পরিচালিত হবে। দেশের শীর্ষ আলিম, মুফতি, ফকীহ ও মুহাক্কিক আলিমগণ এতে দরস প্রদান করবেন। উক্ত তাখাসসুসসমূহ এমফিল হিসেবে কওমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বীকৃত হবে। পাশাপাশি এর অধীনে নানা বিষয়ে রিসার্চ সেল গঠন করা হবে। সকল তাখাসসুস এর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস প্রণয়ন করবে আল হাইআতুল উলয়া। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির ব্যবস্থাও থাকবে।
6. কওমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনকারীদের জন্য দেশসেবার ও দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রসমূহে দেশসেবার সুযোগ দিতে হবে:
ক) বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে দেশসেবার সুযোগদান।
খ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষক পদে নিয়োগদান;
গ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদান;
ঘ) মডেল মসজিদসহ সরকারি মসজিদ এবং সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের মসজিদের ইমাম ও খতিব পদে নিয়োগদান;
ঙ) সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীতে ধর্মীয় শিক্ষক পদে নিয়োগদান,
চ) জেলখানার ধর্মীয় শিক্ষক পদে নিয়োগদান;
ছ) মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) পদে নিয়োগদান।
জ) ওয়াকফ মন্ত্রনালয়ে নিয়োগদান।
ঞ) এছাড়া বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী স্টাডিজ ও এরাবিক বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনকারীদেরকে যে সকল সরকারী ও বেসরকারী চাকরিতে সুযোগ প্রদান করা হয়, কওমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনকারীদেরকেও অনুরূপ সুযোগ দিতে হবে।
নিম্নবর্ণিত প্রতিষ্ঠানসমূহে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে:
ক) দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারত;
খ) দারুল উলূম করাচী, পাকিস্তান;
গ) জামিয়া ইসলামিয়া মদীনা ইউনিভার্সিটি;
ঘ) জামেয়া আল-আযহার, মিসর;
ঙ) কাতার ও মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটিসমূহ;
চ) মরক্কোর আল-কারবীন (deal) ইউনিভার্সিটি;
ছ) তুরস্কের ইসলামিক ইউনিভার্সিটিসমূহ;
জ) দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এমফিল ও পিএইচডির সুযোগদান।
ঝ) এছাড়া নৈতিকমান সমৃদ্ধ বিশ্বের যে কোনো মুসলিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়।
7. যারা বিগত সময়ে, আল হাইআতুল উলয়ার প্রতিষ্ঠার পূর্বে দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল)-এ উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদেরকে একটি বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই মানের ডিগ্রি ও মাস্টার্স- এর সনদ প্রদান করা হবে।
8. যারা ইতোমধ্যে তাখাসসুস সম্পন্ন করেছেন, তাদেরকে নির্ধারিত রিসার্চ পেপার জমা দেয়ার শর্তে কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সংশ্লিষ্ট সনদ প্রদান করা হবে।
কর্মসূচি : এক. ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ অক্টোবর’২৪ পর্যন্ত দেশব্যাপী জেলা পর্যায়ে উক্ত দাবী বাস্তবায়নে সেমিনার ও শিক্ষা অফিসার বরাবর স্মারকলিপি পেশ। দুই. অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় জাতীয় সমাবেশ।
বার্তা প্রেরক
মাওলানা নূরুল করীম আকরাম
কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ